অমর কথাশিল্পী মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্য-রত্ন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক মুসলিম ঔপন্যাসিক। যেকালে বাঙালি মুসলিম সমাজে নাটক-নভেল লেখা দূরে থাক, পড়াও নিষিদ্ধ ছিল। কারণ ঐ সময় সাধারণত হিন্দুরাই নাটক-নভেল লিখতেন। সেখানে যুবক-যুবতীদের অবৈধ প্রেম ও নানারূপ অসামাজিক বিষয়ের বর্ণনা থাকত। ইসলামী শরীয়তে বিবাহ-বহির্ভূত প্রণয় ও নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা নিষিদ্ধ। তাই মুসলিম সমাজে এ ধরনের সাহিত্য অধ্যয়নের প্রতি অলিখিত নিষেধাজ্ঞা প্রচলিত ছিল। এছাড়া, হিন্দুদের লেখায় বিশেষভাবে হিন্দুধর্ম, হিন্দু দেব-দেবীদের মাহাত্ম্য, মন্দির, পূজা-পার্বণ ইত্যাদির বর্ণনা থাকায় মুসলিম সমাজে তা গ্রহণযোগ্য ছিল না।
নজিবর রহমান সর্বপ্রথম মুসলিম চরিত্র, মুসলিম পারিবারিক ও সামাজিক বিষয় এবং ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে উপন্যাস রচনা করেন। অবৈধ প্রেম ও অনৈতিক বিষয়াদির উপস্থাপনা না করে তিনি পবিত্র দাম্পত্য প্রেমের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন। তাঁর সাহিত্যে সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও উত্তম চরিত্রের বিজয় এবং অসত্য, অন্যায় ও অসততার দুঃখময় পরিণতি দেখানো হয়েছে। এছাড়া, অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পতনের কারণ নির্দেশ ও তা দূরীকরণের মাধ্যমে সমাজের উন্নতি ও ইসলামের মাহাত্ম্য বিশেষভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার ও দারিদ্র্য এগুলোকে সমাজের অধঃপতনের মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করে নজিবর রহমান সুশিক্ষা, সুনীতি, সৎ ব্যবসা ও উৎপাদনমুখী উদ্ভাবনী কৃষিকর্মের মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নের দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এজন্য তিনি উপযোগী ঘটনা, কাহিনী ও দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। তাঁর উপন্যাসে ইসলামের মাহাত্ম্য বর্ণিত হলেও, হিন্দুধর্ম বা হিন্দু সমাজের প্রতি কোন বিদ্বেষভাবের প্রকাশ ঘটেনি। এ কারণে তাঁর গ্রন্থ সর্বশ্রেণির পাঠক সাদরে গ্রহণ করে।
বিভিন্ন ধর্মে সতীত্ব, দাম্পত্য-প্রেম ও পতিব্রতা রমণীদের কাহিনী রয়েছে। ইসলাম ধর্মে যেমন হিন্দুধর্মেও তেমনি নারীর সতীত্ব, দাম্পত্য-প্রেম ও পতিপরায়ণতার বিভিন্ন দৃষ্টান্ত রয়েছে। নারী-পুরুষ উভয়ের সততা ও কর্মনিষ্ঠার ফলে পারিবারিক ও সমাজ জীবনে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে, নজিবর রহমান চমৎকারভাবে তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে তা তুলে ধরেছেন। তাই সহজ-সরল শান্তিপূর্ণ পারিবারিক জীবন যারা পছন্দ করেন, তাদের নিকট নজিবর রহমান অত্যন্ত জনপ্রিয়। বলতে গেলে, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি, নাটক-নভেল পড়ার প্রতি মুসলিম সমাজের আগ্রহ সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর উপন্যাসসমূহ এক ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে মুসলিম শিক্ষিত ও সাহিত্যানুরাগী ব্যক্তিগণ ধীরে ধীরে নাটক-নভেল রচনা ও অধ্যয়নে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে নজিবর রহমান মুসলিম কথা-সাহিত্যিকদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
সাহিত্য-সৃষ্টি, সাহিত্যের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি এবং অন্যদের মধ্যে সাহিত্যসৃষ্টির অনুপ্রেরণা সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর অসাধারণ ভূমিকা ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। অধঃপতিত মুসলিম সমাজ উন্নয়নে তাঁর যে গভীর আগ্রহ ছিল, শিক্ষা-সাহিত্য প্রসারে তাঁর প্রাগ্রসর চিন্তা ও নিষ্ঠাপূর্ণ অবদান সে আগ্রহেরই সম্পূরক হিসাবে কাজ করেছে।
সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আর একটি উল্লেখযোগ্য অবদানের বিষয় বিশেষভাবে স্মরণীয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম প্রচলিত স্টান্ডার্ড বেঙ্গলি ল্যাংগুইজ-এ অর্থাৎ বইয়ের ভাষায় বাঙালি মুসলিম সমাজে বহুল প্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দরাজি ব্যবহার করেন। এজন্য প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে তাঁর কঠোর সমালোচনা হলেও এক্ষেত্রে তিনি তাঁর অনুসৃত পথ থেকে সরে আসেননি। বরং শেষ পর্যন্ত অনেক নিরপেক্ষ হিন্দু পণ্ডিত ও সাহিত্যিক এজন্য তাঁর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন এবং তাঁকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। এভাবে নজিবর রহমান সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়কে সমুন্নত করেছেন।
লেখক- মুহাম্মদ মতিউর রহমান