মোহাম্মদ নজিবর রহমান বাংলা ভাষায় উপন্যাস রচনার ইতিহাস দীর্ঘ দিনের নয়। ঊনিশ শতকে ইংরাজি ভাষা-সাহিত্য, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলা সাহিত্যে যে আধুনিকতার উন্মেষ ঘটে, সে উন্মেষলগ্নে ইংরাজি সাহিত্যের আদলে উপন্যাস রচনার সূত্রপাত ঘটে। ইংরাজ আমলের পূর্বে বাংলা সাহিত্য বলতে শুধু বাংলা কাব্য ও কবিতাই বুঝাতো। সে কাব্য-কবিতাও ছিল মূলত গীতিকবিতা, কাহিনী কাব্য ও চরিতকাব্য। ছন্দ বলতে তখন প্রধানত পয়ার ছন্দ বুঝাতো। ইংরাজ আমলে ইংরাজি সাহিত্যের অনুসরণে আধুনিক বাংলা কাব্যে বিভিন্ন রূপরীতি ও বিচিত্র ছন্দের প্রচলন ঘটে। বাংলা কাব্যে আধুনিকতার প্রচলনে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩) পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি গীতিকবিতা, মহাকাব্য, নাট্যকাব্য, সনেট, প্রহসন ইত্যাদি রচনা করেন। ইংরাজি ব্লাঙ্ক ভার্সের অনুসরণে তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করে বাংলা কাব্যে অমিত সম্ভাবনা, প্রাণময়তা ও অভিনব ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেন। ভাব ও চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রেও তিনি বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানমনষ্ক ও যুক্তিসিদ্ধ মানবিক চিন্তাধারার প্রবর্তন ঘটান।
মুসলিম আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপক উন্নতি ও উৎকর্ষ সাধিত হলেও তা ছিল মূলত বাংলা কাব্য-সাহিত্য। বাংলা গদ্যের প্রচলন তখনও ঘটেনি। অবশ্য দু’একটি রাজকীয় ফরমান ও দলিল-দস্তাবেজে বাংলা গদ্যের কিছু কিছু নিদর্শন পাওয়া গেলেও যথার্থ অর্থে সেগুলো সাহিত্য পদবাচ্য বলে গণ্য হতো না। মুসলিম শাসনামলের শেষ দিকে প্রধানত খ্রীষ্টান পাদ্রীদের ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাইবেলের অনুবাদের মধ্য দিয়ে বাংলা গদ্যের লিখিত রূপ প্রথম লক্ষ্য করা যায়। সতেরো শতকের প্রথমার্ধে পর্তুগীজ পাদ্রীগণ খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করেন। এরপর এ শতকের মাঝামাঝি খ্রীষ্টান মিশনারি দোম আস্তনিও বাংলা গদ্যে ‘ব্রাহ্মণ রোমান ক্যাথলিক সংবাদ’ রচনা করেন। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও খ্রীষ্টান পাদ্রীর কথপোকথনের মাধ্যমে হিন্দুধর্মের অসারতা ও খ্রীষ্টান ধর্মের সারবত্তা প্রমাণ করা ছিল এ গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য। এটাকে যথার্থ অর্থে যদিও সাহিত্যিক গদ্য বলা যায় না, তবু বাংলা গদ্যের একটি প্রাথমিক রূপ এরমধ্যে বিধৃত।
বাংলা ভাষায় তখনো কোনো ব্যাকরণ ছিল না। এতে বিদেশীদের বাংলা শিখতে বেশ অসুবিধা হতো। এ অসুবিধা দূরীকরণার্থে ১৭৩৪ সালে মানোএল দা আস্সুম্প্সাঁও নামে জনৈক পর্তুগীজ পাদ্রী সর্বপ্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন। ব্যাকরণের সাথে তিনি একটি বাংলা শব্দকোষও ছেপেছিলেন।১ এভাবে বাংলা গদ্যের সূচনালগ্নে পর্তুগীজ পাদ্রীদের কিছু অবদান লক্ষ্য করা যায়।
এছাড়া, মুসলিম আমলে বাংলা গদ্যের আরো নিদর্শন পাওয়া যায় দলিল-দস্তাবেজ, চিঠিপত্র, সরকারি ফরমান, চুক্তিপত্র ইত্যাদিতে। কিন্তু এ বাংলা গদ্যে প্রচুর ফরাসি শব্দের সংমিশ্রণ থাকায় অনেকে একে বাংলা গদ্য বলে স্বীকার করতে রাজি নন। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একে ‘ঁহৎবধফধনষব’, ‘অপাঠ্য কদর্য’ ভাষা বলে আখ্যায়িত করেন। ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন এ ভাষা সম্পর্কে মন্তব্য করেন ঃ “রাজ-দরবারে (মুসলিম আমলে) উর্দু ও সংস্কৃত মিশিয়া একরূপ বিকৃত বাঙ্গালা গদ্য গঠন করিয়াছিল; …দলিল প্রচলিত ভাষায় সেই বিকৃতরূপের নমুনা কিছু বিদ্যমান আছে। …সরকারি কাছারী ও জমিদারি সেরেস্তায় প্রাচীন জটিল গদ্য বদ্ধমূল হইয়া রহিয়াছে, সেখানে সংস্কারের বীজ এখনও স্থান পাইতেছে না।”
এ তথাকথিত সংস্কারকর্ম সাধিত হয় ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ স্থাপনের পর। এ কলেজের মাধ্যমে ইংরাজ পাদ্রী ও সংস্কৃত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের যৌথ উদ্যোগে প্রচলিত বাংলা ভাষায় অনুপ্রবিষ্ট ও আত্মীকৃত অসংখ্য আরবি- ফারসি-উর্দু ভাষার শব্দ বাদ দিয়ে তার বদলে দুর্বোধ্য সংস্কৃত শব্দ সমন্বিত কৃত্রিম বাংলা চালু করা হয়। এ নতুন বাংলার নাম দেয়া হয় ‘সাধু বাংলা’। ফোর্ট উউলিয়ম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন শ্রীরামপুরের ইংরাজ পাদ্রী উইলিয়ম কেরী। তাঁর অধীনে যেসব ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বাংলা বিভাগের শিক্ষক নিযুক্ত হন তাঁরা হলেন ঃ মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার, রামনাথ বিদ্যাবাচষ্পতি, শ্রীপতি মুখোপাধ্যায়, আনন্দচন্দ্র, কাশীনাথ, পদ্মলোচন চূড়ামণি ও রামনাথ বসু। এসব পণ্ডিতের হাতেই সংস্কৃতবহুল নতুন সাধু বাংলার জন্ম। এ সম্পর্কে গবেষক নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান বলেন ঃ
“এই পণ্ডিতেরাই নতুন দিনের সংস্কৃত বাঙ্গালা ভাষা গড়িয়া তুলিলেন। রামরাম বসু লিখিলেন ‘রাজা প্রতাপাদিত্য’ ও ‘লিপিমালা’। মৃত্যুঞ্জয় লিখিলেন ‘বত্রিশ সিংহাসন’, ‘প্রবোধ চন্দ্রিকা’। রাজীবলোচন লিখিলেন ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং’। রামকিশোর লিখিলেন ‘হিতোপদেশ’। মোহন প্রসাদ লিখিলেন ‘ইংরেজি-বাংলা শব্দকোষ’ ও ‘ইংরেজি-ওড়িয়া অভিদান’। হরপ্রসাদ লিখিলেন ‘পুরুষ পরীক্ষা’। কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন লিখিলেন ‘পদার্থ কৌমুদী’ এই পুস্তকগুলির অধিকাংশই ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলা বিভাগের পাঠ্য-পুস্তক ছিল।”২
লেখক-মুহাম্মদ মতিউর রহমান